আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি।
তোমায় দেখতে আমি পাই নি।
গানটি পরমেশ্বরের প্রতি এক মানবিক নিবেদন। আমরা ব্যক্তিগতভাবে যে ধর্মই পালন করি, আস্তিক হই কিংবা নাস্তিক হই এক অবিনশ্বর “পরম সত্ত্বা”য় বিশ্বাস আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি। এমনকি মানুষ “নাস্তিক” হলেও এক পরমেশ্বরের ধারণা তার মনের মধ্যে থেকেই যায়। নাস্তিক মানুষেরা হয়ত প্রচলিত কোনো ধর্মমতে বিশ্বাস করে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তারা এক “পরম স্রষ্টা”র ধারণাকে অস্বীকার করতে পারে। এই গানটিতে যে “আমি” বা “আমার” কথা বলা হয়েছে সেটি সার্বজনীন “আমি”। আসলে সব মানুষের মনের মধ্যেই সৃষ্টিকর্তা লুকিয়ে থাকেন কিন্তু তাঁকে খুঁজে নেয়ার বা চিনে নেয়ার সময় বা সুযোগ অনেকেরই সবসময় হয় না। জীবনের পড়ন্তবেলায় অথবা হঠাৎ কোনো উপলক্ষ্যে তাঁকে চিনে নেয়ার সময় চলে আসে। তখনই মানুষ গেয়ে ওঠে এই কলিটি, “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পাই নি। তোমায় দেখতে আমি পাই নি।“
বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়-পানে চাই নি ॥
“বাহির” বলতে বোঝায় “জাগতিকতা”। আমি জাগতিক কাজকর্ম, বিষয়চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। জীবন যাপনের ব্যস্ততায় মগ্ন থেকেছি। কিন্তু আমার হৃদয়ের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষার দিকে দৃষ্টি বা মনোযোগ দিতে পারিনি। এখানে “চোখ মেলেছি” আর “চাই নি”- শব্দবন্ধ দু’টি লক্ষ্যণীয়। “চোখ” একটি ব্যবহারিক ইন্দ্রিয় যা দিয়ে বাইরের জগতকে “দেখা” চলে। সেই “চোখের” দেখা শুধুই বস্তুনিষ্ঠ বিচার। অর্থাৎ “চোখ” যাকিছু “দেখে” সেগুলোর স্বরূপ বা পরমমূল্য নির্ধারণ করতে পারে না। এই চোখের দেখা দিয়ে শুধুই ব্যবহারিক কাজ চলে। আবার অন্যদিকে “চাই নি” বা “দৃষ্টি নিক্ষেপ করিনি” বা “তাকাই নি” বলতে যেন শুধুই “দেখা” বুঝায় না বরং এখানে বস্তু বা বিষয়ের “স্বরূপ বিচার” করার প্রসঙ্গটি চলে আসে। হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষাকে শুধু “চোখ” মেলে দেখা যায়না। সেটি অনুভব করতে হয়। কিন্তু জাগতিক ব্যস্ততায় আমি আমার হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষাকে অনুভব করার সময় পাইনি।
আমার সকল ভালোবাসায় সকল আঘাত সকল আশায়
তুমি ছিলে আমার কাছে, তোমার কাছে যাই নি ॥
এখানে আমাদের এই জাগতিক জীবন যাপনের অমোঘ চক্রটি তুলে ধরা হয়েছে। জগতে চলার পথে আমরা বাবা-মা, টাকাপয়সা, স্ত্রী-সন্তানাদি, চাকুরি ব্যবসা, পেশা ইত্যাদিকে বিভিন্নভাবে ভালোবাসি। তারপর সেই ভালোবাসার ফলস্বরূপ কমবেশি আঘাত আসে। কিন্তু আঘাত পেয়ে আমরা থেমে যাই না। আবার আশায় বুক বাঁধি। ভালোবাসা অব্যাহত রাখি। জীবন চলার পথে “ভালোবাসা-আঘাত-আশা”র এই ক্রমটি কিন্তু আসেলই সত্য। যাহোক, এই আটপৌরে জীবনের “ভালোবাসা-আঘাত-আশা” এর মাঝখানে আসলে পরমেশ্বরই আমাদেরকে শক্তি যোগান। কিন্তু আমরা সে ব্যাপারে সবসময় সচেতন থাকি না। আমাদের এই প্রাত্যহিক জীবন যাপনে স্রষ্টা আমাদের সাথেই থাকেন কিন্তু আমরা সবসময় তা টের পাইনা। জীবন যাপনে স্রষ্টার করুণা অনুভব করার যোগ্যতা যখন আমাদের হয় তখন আমরা বুঝতে পারি যে, স্রষ্টা আমাকে এত ভালোবাসেন অথচ আমি তাঁকে ততটা ভালোবাসতে পারিনি। (আমি তোমার কাছে যাইনি)।
তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে আমার খেলায়–
আনন্দে তাই ভুলেছিলেম, কেটেছে দিন হেলায়।
রবীন্দ্রনাথে “খেলা” হলো তার “সাহিত্যরচনা”, তার “লেখালেখি”ই তার খেলা। রবীন্দ্রনাথ পরমেশ্বরকেই তার লেখক সত্ত্বার প্রেরণা হিসেবে মনে করেন। আবার সার্বিকভাবে যেকোনো মানুষই জগতে কোনো না কোনো পেশা বা কর্মে লিপ্ত থাকে। মানুষ তার পেশাকে ভালোবাসে, ঠিক যেমন একটা শিশু খেলাধূলা করতে ভালবাসে, খেলাধূলায় আনন্দ পায়। আমরা আমাদের পেশা, কর্ম কিংবা চূড়ান্ত অর্থে আমাদের এই জীবন যাপনকে আনন্দময় ভাবতে পারি কারণ ঈশ্বরই আমাদেরকে সেই আনন্দ যোগান। একটা শিশু সাধারণ খেলাধূলায় আনন্দ পায় কেন? কারণ শিশুরা মানসিকভাবে “নির্ভার” থাকে। জগতের সমস্ত “উদ্বেগ” থেকে মুক্ত থাকে বলেই শিশুরা খেলাধূলায় “আনন্দ” পায়। ঠিক একইভাবে আমরা আমাদের অবচেতন মনে পরমেশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখি বলেই আমরা সেই শিশুদের মতোই “উদ্বেগহীন” বা “নির্ভার” জীবন যাপন করতে পারি। সেই নির্ভার জীবন যাপন তখন “খেলাধূলা” করার মতোই আনন্দময় হয়ে ওঠে। আর পরম স্রষ্টা’ই আমাদের সেই খেলাতে আনন্দ যোগান। কিন্তু আমরা জীবন যাপনের আনন্দে এতই মশগুল থাকি যে, যিনি আমাদেরকে আনন্দ যোগান সেই পরমেশ্বরের কথাই আমাদের সচেতনভাবে মনে থাকে না। নিত্যদিনের জীবন যাপনে তাঁকে আমরা ভুলে যাই যদিও আমাদের অবচেতনে অবস্থান করে তিনি ঠিকই আমাদেরকে আনন্দ যোগান। যখন আমাদের উপলদ্ধি আসে তখন আমরা দেখতে পাই যে, এতদিন আমরা পরম স্রষ্টার দিকে যথোপযুক্ত মনোযোগ দিইনি।
গোপন রহি গভীর প্রাণে আমার দুঃখসুখের গানে
সুর দিয়েছ তুমি, আমি তোমার গান তো গাই নি ॥
পরমেশ্বর আমাদের “গভীর প্রাণে” বা “অবচেতনায়” অবস্থান করেন এবং আমাদের জীবন যাপনে, আমাদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকেন। জীবনে আমরা পালাক্রমে দুঃখ ও সুখের আবেগে জারিত হই। এই দুঃখ ও সুখের আবেগই হলো “দুঃখসুখের গান”। আমাদের এসব দুঃখ ও সুখের আবেগে ঈশ্বরই আমাদেরকে যথাক্রমে “সান্ত্বনা” ও “প্রেরণা” দান করেন। এই “সান্ত্বনা” ও “প্রেরণা”ই হলো “সুর”। আমাদের “সুখের গানে” ঈশ্বর “সুর” দেন- সেটি না হয় বুঝলাম। “দুঃখে”র গানের “সুর” আবার কি? হ্যাঁ, দুঃখের গানেরও “সুর” আছে। মানুষ যে শোকের কান্না কাঁদে সেটিও কিন্তু বেসুরো নয়। ওখানেও “সুর” থাকে। তাতে দুঃখ কিছুটা লাঘব হয়। “সুর” সেখানে “সান্ত্বনা”র যোগান দেয়। এভাবে পরমেশ্বর আমাদের জীবন যাপনে দুঃখের দিনে সান্ত্বনা দেন আর সুখের দিনে প্রেরণা যোগান। যে পরম স্রষ্টা আমাদেরকে এত ভালোবাসেন সেই পরম স্রষ্টার কাছে নিজেকে নিবেদন করার সময় আমরা এযাবত পাইনি। তাঁর গুণগান করার কথা ভাবিনি।
যাহোক, গানটি মানুষের সহজাত ঈশ্বরভাবনার আবেগকে তুলে ধরেছে। ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করার আকুতি তুলে ধরেছে।
প্রসঙ্গত বলা যায়, গানটি যদিও নিখাঁদ ঈশ্বরপ্রেমেরই গান তবুও একটু ঘুরিয়ে একে “নর-নারীর” মানবিক প্রেমের গানও বলা যায়। একথা ঠিক যে, পুরুষের মনে “নারী”প্রেমের উদ্বোধন না হলে সেই পুরুষ “ঈশ্বর”প্রেমে শতভাগ সফল হয়না। একই কথা “নারী” বেলাতেও খাটে। অনেক ধর্মেই “ঈশ্বরপ্রেম”কে “নর-নারী”র মানবিক “প্রেম” এর রূপক আকারে তুলে ধরা হয়েছে। এমনকি ইসলাম ধর্মেও দেখা যায় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) যখন তাঁর উপর ঐশীবাণী অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে নিজেই সন্দিহান ছিলেন তখন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী বিবি খাদিজা (রাঃ) এর উৎসাহ ও প্রেরণাই তাঁকে “সাহসী” করে তুলেছে। বিবি খাদিজা’র দেয়া “ভরসা”ই তাঁকে ঐশী বাণীর উপর “ভরসা” স্থাপনে সাহায্য করেছে। মুহাম্মদ (সাঃ) কে বিবি খাদিজা (রাঃ) “ভরসা” না দিয়ে “নিরুৎসাহিত” করলে ইসলামের ইতিহাসই হয়ত ভিন্নভাবে লেখা হতো। অথবা, মুহাম্মদ (সাঃ) আর বিবি খাদিজা (রাঃ) এই “মানবিক” প্রেমের শক্তির মধ্য দিয়েই পরম স্রষ্টা নিজেকে প্রকাশ করার ইচ্ছা করেছেন। এটাই সেই নর-নারীর “মানবিক” প্রেমের শক্তি। সেই হিসেবে এটি “নর-নারীর” মানবিক প্রেমের গানও বটে। “নর-নারী”র প্রেমে যখন তারা নিজেদের “রূপ-চেহারা-জৌলুস” ছেড়ে পরস্পরকে “মনের আলোয়” দেখতে পায় তখন এই গানটি তাদের ভালো লাগতেই পারে।
ফিরোজ আহমেদ- ৩০/৬/১৭